অডিওবুক(Audiobook) এখন বই পড়ার বিকল্প এক জনপ্রিয় মাধ্যম। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে বিশ্বব্যাপী অডিওবুক শ্রোতার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কাজের ফাঁকে, যাতায়াতের পথে বা বিশ্রামের সময় – মানুষ এখন শোনার মাধ্যমে জ্ঞান ও বিনোদন অর্জন করছে। এই ব্লগে আমরা অডিওবুক শিল্পের সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অগ্রগতি, এর ফলে মুদ্রিত বই শিল্প ও সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে তা নিয়ে আলোচনা করবো।
বিশ্বব্যাপী অডিওবুক শিল্পের সাম্প্রতিক অগ্রগতি
বিশ্বজুড়ে অডিওবুক শিল্পটি অবিশ্বাস্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অডিওবুক বাজারের মূল্য ছিল প্রায়$৬.৮৩ বিলিয়ন, এবং পূর্বানুমান অনুযায়ী ২০২৪-২০৩০ সময়কালে এই খাতে বার্ষিক যৌগিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২৬.২% হতে পারে।
স্মার্টফোনের ক্রমবর্ধমান প্রসার এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উন্নতির ফলে অডিওবুক যে কোনো সময় ও যে কোনো স্থান থেকে শোনা সম্ভব হচ্ছে, যা এই বাজারের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে।
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে অডিওবুকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে– তারা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে সেলফ-হেল্প বই পর্যন্ত শুনছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহারে ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী অডিওবুক সুপারিশ করার সুবিধাও এই বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, স্পটিফাই ২০২৪ সালে গ্রাফ নিউরাল নেটওয়ার্কভিত্তিক একটি অডিওবুক রিকমেন্ডেশন ইঞ্জিন চালু করেছে যাতে শ্রোতাদের পূর্বের শুনার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পছন্দসই বই সুপারিশ করা যায়।
অডিওবুকের এই জোয়ার বই শিল্পের বাজারের ভারসাম্যও বদলে দিচ্ছে। শুধু বিক্রির পরিমাণ নয়, বই শোনার অভ্যাসের ফলে নতুন শ্রোতা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। বিশেষত, যেসব মানুষ আগে বই পড়তেন না বা কম পড়তেন – যেমন অনেক তরুণ পুরুষ শ্রোতা– তারাও এখন অডিওবুকের মাধ্যমে সাহিত্যে ফিরে আসছেন।
ফলে অডিওবুক প্রথাগত বইবাজারের অংশ কেড়ে নিচ্ছে না; বরং নতুন শ্রোতা যোগ করে বইয়ের মোট বাজারটিকেই সম্প্রসারিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা শিল্পে বর্তমানে মোট বই বিক্রয়ের প্রায় ৯% আসে অডিওবুক থেকে, যা ই-বুকের ভাগের কাছাকাছি। পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ২০% ছাড়িয়ে যেতে পারে। নির্দিষ্ট কিছু বিভাগে তো অডিও সংস্করণের বিক্রয় মুদ্রিত বইয়ের বিক্রয়কেও ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে– যেমন আত্মউন্নয়নমূলক বই বা সেলিব্রিটি মেমোয়ারের ক্ষেত্রে অডিওবুক বিক্রয় প্রিন্ট বিক্রয়ের সমান কিংবা বেশি হতে পারছে। এসবই ইঙ্গিত দেয় যে অডিওবুক এখন আর নিছক নতুনত্ব নয়, এটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশনা খাতে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে।
মুদ্রিত বই শিল্প ও সমাজে অডিওবুকের প্রভাব
অডিওবুকের উত্থান মুদ্রিত বইয়ের জগতে মিশ্র প্রভাব ফেলেছে। একদিকে কিছু পাঠক অডিওবুকের কারণে কম মুদ্রিত বই কিনছেন বলে ধারণা করা হয়, আবার অন্যদিকে অডিওবুক নতুন শ্রোতা-পাঠক তৈরিতে সহায়তা করায় সামগ্রিকভাবে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক প্রকাশনা সংস্থা এখন প্রতিটি বেস্টসেলারের সাথে সাথে তার অডিও সংস্করণও বের করছে – ফলে লেখকরাও নতুন এক শ্রোতা শ্রেণির কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অডিওবুক মূলত বইয়ের বাজারে নতুন সংযোজন হিসেবে কাজ করছে এবং এটি অন্যান্য ফরম্যাট (প্রিন্ট ও ই-বুক) থেকে শুধু শ্রোতা টেনে নিচ্ছে না বরং নতুন ভোক্তা তৈরি করছে। বিশেষ করে যারা ব্যস্ততা বা মনোযোগের অভাবে বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, অডিওবুক তাদের আবার গল্প-জগতের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফলে সমাজে জ্ঞানচর্চা ও গল্পশোনার সংস্কৃতি নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
অডিওবুকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব হলো অন্তর্ভুক্তি ও অ্যাক্সেসিবিলিটি বৃদ্ধি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিংবা পড়তে অসুবিধা হয় এমন ব্যক্তিদের জন্য অডিওবুক একটি আশীর্বাদস্বরূপ। আগে যেসব সাহিত্য হয়তো এদের কাছে পৌঁছাত না, অডিও ফরম্যাটে সেগুলো সহজেই তারা গ্রহণ করতে পারছেন। পরিবারে একসাথে অডিওবুক শোনা, বা বাবা-মা সন্তানকে শোনানোর জন্য অডিও গল্প চালু করা – এ ধরনের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। আবার ব্যস্ত নগরজীবনে যানজটে বসে বা কাজের ফাঁকে কানে হেডফোন লাগিয়ে বই শোনার অভ্যাস তৈরি হয়েছে, যা বিনোদনের ধরন পরিবর্তন করছে। সব মিলিয়ে, অডিওবুক সমাজে জ্ঞানপ্রবাহকে গতিশীল করেছে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে গল্প ও জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। তবে এর ফলে দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রেখে পড়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে কি না, কিংবা ভাষার সৌন্দর্য উপভোগের অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে কি না – এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন মুদ্রিত বই পড়ার অভিজ্ঞতা আলাদা, তবে অডিওবুক সেই অভিজ্ঞতার বিকল্প নয় বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।